নিতুর শেষ চিঠি


আমি জানি না আদৌ মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পেরেছি কিনা তবে দৈহিক এবং শারীরিকভাবে বড় হয়েছি তা নিশ্চিত, তবে এই বৃদ্ধিটার জন্য 

 যে মানুষটা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে দিনরাত,

আমার সুখ এবং মানুষ হওয়ার কথা চিন্তা করে সব একাকার করে নিচ্ছে যিনি তিনি আমার মা।


মায়ের মুখ থেকে শুনা আমার জন্মের পরপরই বাবা মারা যায়।

আমাকে মায়ের আদর বাবার আদর দুটোই মা দিয়েছে, 

মাকে কখনও দেখি নি ক্লান্ত হয়ে সংসারের হাল ছেড়ে দিতে!


আমার মা একজন স্কুলের শিক্ষিকা। 

 স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি কয়েকটা টিউশনি করে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করে থাকে।

মাকে সব সময় দেখি ক্লান্তিহীন অবিরাম গতিতে স্কুল,  টিউশনি, সংসার সব এক হাতে গুছিয়ে চলেছেন।


মাকে যখনি বাবার কথা জিগ্যেস করি, 

মা,  বাবা  দেখতে কি রকম ছিলেন?

বাবা কি কাজ করতেন?

বাবা কিভাবে মারা গেলেন?


এই সব প্রশ্ন শুনে মা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যান,

মা আনমনা হয়ে যান।

মা যে উত্তর গুলো দেন সেগুলো শুনে আমি আরও হকচকিয়ে যাই,


তুমার বাবা দেখতে মানুষের অবয়বেই ছিলো।

তুমার বাবা প্রকৃতির সাথে খেলা করতে গিয়ে প্রকৃতির মাঝেই বিলীন হয়ে গিয়েছে।

মায়ের এসব কথার আগা গোড়া কিছুই বুঝে উঠতে পারি না।


মায়ের কিছু উপদেশ সব সময় কানে বাজে।

শোন অনি, মানুষের অবয়ব নিয়ে বেড়ে উঠলেই কিন্তুু মানুষ হওয়া যায় না।

মানুষ হওয়ার জন্য মেহনত করতে হয়,

মানুষ হওয়ার জন্য মেহনতি মানুষের সুখ দুঃখ বুঝতে হয়।


মানুষ হওয়ার জন্য মেহনতি মানুষের সাথে মিশে মনুষ্যত্ববোধ অর্জন করে নিতে হয়।।

একজন পরিপূর্ণ মানুষ হতে হলে তা একদিনেই আপনা আপনি হওয়া যায় না,

আর শোন, কখনও অসৎ সঙ্গে মিশতে যাবি না,

যদি সঙ্গ না মিলে প্রয়োজনে একা চলবি, একা ঘুরবি,


রবীন্দ্রনাথের কঠিন ভক্ত আমার মা,

বাসায় সব সময় রবীন্দ্রনাথের গান বাজে, 

যার একমাত্র শ্রোতা আমার মা।


যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে এই নীতিতে অটল আমার মা,

মা সব সময় এমন উপদেশমুলক কথা বলে তা কিন্তু নয়, 

যখন বাবার প্রসঙ্গ আসে তখনই মা উপদেশমুলক কথা বলে।


একদিন মা বলতেছে শোন অনি,

 বিষাক্ত রক্ত কিন্তুু বিশুদ্ধ রক্তের দিকে ধাবিত হয়,

কেন জানিস?

 বিশুদ্ধ রক্তটাকে বিশাক্ত করার অভিপ্রায়ে,

অতএব তর চলনে বলনে বিষাক্ত আর বিশুদ্ধতার প্রমান মিলবে। 


আমার পড়াশোনা শেষ করে একটা প্রাইভেট ফার্মে জব নিয়েছি ৫ বছর হলো,

কিন্তুু আজ অফিসে এসে চেম্বারে বসার পর শুনি রিসিপশনে আমার একটা চিঠি আসছে,

ডিজিটালাইজড এই যুগে এখনও প্রাচীনকালের পদ্ধতিতে যোগাযোগ, 

ভাবলেই রোমাঞ্চকর অনুভূতি কাজ করে,

চিঠির খামটার উপর বড় বড় অক্ষরে লেখা  নিতু,

বুকটা মোচর দিয়ে উঠলো,


নিতুর সাথে সম্পর্ক ছিল প্রায় ৫ বছর সেই কলেজ  লাইফ থেকে, 

আমার চাকরীতে ডুকার কিছুদিন পর শুনি 

নিতুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে,

বিয়েতে নিতুর পুরোপুরি মত ছিল এবং সাচ্ছন্দ্যে সে তার নতুন বরকে গ্রহন করেছিলো।


তাই একটা অভিমান আক্ষেপ নিয়ে সেদিন থেকে ওর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলাম।

কিন্তুু আজ হঠাৎ এই চিঠিটা দেখে একটু অবাক হয়ে গেলাম।


চিঠির শুরুতেই প্রিয়  সম্বোধন, 


অনি ভালো আছো জানি, কারন ভাল মানসিকতার মানুষগুলো সব সময় ভাল থাকে তা আমার অজানা নয়। 

কিন্তুু আমি ভালো নেই,কারন আমি খুবই স্বার্থপর টাইপের সুখ অন্বেষী একজন মানুষ,

অনি তুমাকে সেদিন প্রত্যাখ্যান কেন করেছিলাম জানো?


আমার পরিবারের সকলেই তুমার আর আমার সম্পর্কের বিষয়টা জেনে গিয়েছিলো,

তুমার সাথে সম্পর্ক জানার পর বাবা একদম রেগে মেগে আগুন,

কিছু অপ্রিয় কথা বলবো যদিও তুমি অনেক কষ্ট পাবা তবুও বলবো।


বাবা তুমার সম্পর্কে জানার পর তুমার বাবার ইতিহাস আলোচনা শুরু করে।


তুমার বাবা নাকি একদম ভবঘুরে নেশাগ্রস্ত নারীলোভী অকর্মা একজন লোক ছিলো মহল্লার,

তুমার বাবা নাকি যৌবনে অনেক মেয়েদের শ্লীলতাহানি করেছিল। 


তাছারা তুমার বাবাকে পুরো নগরীর পতিতা-দের মনোরঞ্জনকারী ওস্তাদ হিসেবে এক ডাকে সকলেই চিনতো।


তুমার বাবাকে এলাকার লোকেরাই গুম করে ফেলে,

যে মৃত্যুটাকে তুমার মা প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়া বলে তুমাকে বলে আসতেছে।


এই কারনে তুমার প্রতি আমার বাবার একটা ক্ষোভ ছিলো, 

যদি তুমি তুমার বাবার বিষাক্ত রক্তের ছোঁয়া পেয়ে তুমিও বিষাক্ত হয়ে পড়ো।


তাই আমার বাবা এই মহল্লা ছেড়ে দিয়ে দুরে চলে আসে তুমার কাছ থেকে।

যাতে আমি নিরাপদ থাকি।

এখানে আমারও কিছুটা সম্মতি ছিলো,

আমার নির্লিপ্ততা,আমার নিরবতা,বাবাকেই সমর্থন করেছিলো,


তাছারা এর কিছুদিন পর বাবা একটা বড় ঘরের খানদানি ছেলে নিয়ে আসে আমার জন্য। 

আমিও আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে রাজী হই।


জানো অনি,  বাসর রাতের প্রথম দিন আমার বর পুরোপুরি মাতাল নেশাগ্রস্ত হয়ে আমার সাথে বিকৃত যৌনাচারে লিপ্ত হয়েছিলো।

আমি নিরুপায় দেবী হয়ে শুধু শায় দিয়ে গিয়েছিলাম।

ভেবেছিলাম এগুলো কিছু না,  সব ঠিক হয়ে যাবে সময়ের সাথে সাথে,

কিন্তুু সময়ের সাথে আরও অনেক ভয়ঙ্কর তথ্য বেরিয়ে আসতে লাগল,

আমার স্বামী তার এলাকায় একজন শ্রেষ্ঠ মাদকাসক্ত নেশাগ্রস্ত মাগী খোর। 

যাকে সকল পতিতারা ভগবানের ন্যায় ভয় পায়।

আর আমি নামেমাত্র দাস হিসেবে এই সংসারে রয়ে আছি।


সবচেয়ে মজার বিষয় কি জানো অনি??

আমি তুমার বিষাক্ত রক্তের ছোঁয়া থেকে বাঁচার জন্য বিশুদ্ধ রক্তের সন্ধানে মহল্লা ছেড়ে দিয়েছিলাম নতুন সঙ্গী খুঁজে নিয়েছিলাম।


কিন্তুু আমার কপাল পুরনো ইতিহাসের দিকে টেনে নিয়ে যাবে সেখানে কে আটকাবে!

জানি  তুমাকে অনেক অপ্রিয় অজ্ঞাত কথা বলে মনঃক্ষুণ্ন করে দিলাম,

একটু মনক্ষুন্ন হও না আমার জন্য?

আমি তো অনেক বছর যাবত মন খারাপের তরীতে মাঝি হয়ে বসে আছি। 


 ইতি তুমার নিতু...


আজ আর অফিসে মন বসাতে পারছি না,

বসের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে গেলাম,

বাসায় গিয়ে দরজা খুলতেই মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে,


কিরে অনি, এই অসময়ে অবেলায় অফিস রেখে চলে আসলি কেন???

আমি চুপ চাপ কোনো কথা না বলে বেলকনিতে চেয়ারে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি,,

আর মাকে বলছি মা আমারও মাঝে মাঝে প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে মন চায়।

এটা শুনে মা অজর ধারায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে,,


  লালনের গানটা বার বার শুনতেছি   


 আমি অপার হয়ে বসে আছি

ও হে দয়াময়,

পারে লয়ে যাও আমায়।।


আমি একা রইলাম ঘাটে

ভানু সে বসিল পাটে-

(আমি) তোমা বিনে ঘোর সংকটে

না দেখি উপায়।।


নাই আমার ভজন-সাধন

চিরদিন কুপথে গমন-

নাম শুনেছি পতিত-পাবন


তাইতে দিই দোহাই।।

অগতির না দিলে গতি

ঐ নামে রবে অখ্যাতি-

লালন কয়, অকুলের পতি

কে বলবে তোমায়।।

(কাল্পনিক)

০৫.০৫.২০২১

Post a Comment

Previous Post Next Post